সেই অনুভূতির কথা আর কি বলব ? নাকানিচোবানি অনুভূতি।
ছোটবেলায় রেস্তোরাঁতে খাওয়া মানেই এক প্লেট রসগোল্লা আর সিঙারা। রসগোল্লার রস লাগিয়ে লাগিয়ে সিঙারা খাওয়া । সাথে একখানা চামচ দিত বটে …তবে বেশীরভাগ সময়ই সেটা নীচে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতো নয়তো মা চামচটা সরিয়ে রাখতেন। আর কাঁটাচামচওয়ালা রেস্তোরাঁ আমাদের শিলচরে তখন ছিলই না।
কলেজে ওঠার পর শিলচরে একটা রেস্তোরাঁ খুললো..স্যান্ডঅফ। ওওওও বাবা কি সুন্দর ..হালকা করে গানও বাজে। টেবিলের ওপরে ওপরে লাইট ঝোলানো। বন্ধুরা মিলে গেলাম। কাটলেট অর্ডার করা হলো। কাটলেটে একটা মুরগীর ঠ্যাঙ গুঁজে দিল দেখলাম আর প্লেটে একটা ছুরি আর কাঁটাচামচ। কিছু বন্ধু অলরেডি কাঁটাচামচ দিয়ে খেয়ে এসেছে কোলকাতা থেকে। সুতরাং ওরা এখন বিরাট হনু। দেখলাম স্মার্টলি কুচকুচ করে কাটলেট কাটছে আর কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে। আমি দুটোই হাতে নিলাম। ছুরি চালালাম কাটলেটের বুকে। কিছুতেই কাটেনা। বন্ধুদের বলালাম…দেখ কেমন ভোঁতা ছুরি? কাটবে কি করে ? আমার পাকেশ্বরী বন্ধু ফিক করে হেসে বলল …তুই কি গাউয়া রে !! ইটা ঐতা ছুরি না তো। ইটা হইল গিয়া নাইফ..ভুঁতাই থাকে। শুনে আমি একটু দমে গেলাম। সিনেমা টিনেমাতে কাঁটা ছুরি দিয়ে খাওয়া দেখেছি কিন্তু তখন কেন যে একটু খেয়াল করে দেখিনি। যাইহোক আমার ছুরিকাঘাতে কাটলেট প্রায় গুঁড়ো হবার জোগাড়। কাঁটাচামচ দিয়ে খোঁচা মেরে তোলার মতো অবস্থা আর কাটলেটের নেই। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত দিয়েই খাওয়া সারলাম। তবে আমি একা নই ..বিভিন্ন টেবিলে অনেকেরই আমার অবস্থা দেখে বুকে বল এলো। পরের দিকে মুরগীর ঠ্যাঙটা ধরেই কাটলেট খেতাম আর রেস্তোরাঁর মালিককে বলতাম…কাকু, কাটলেটের সাথে কাঁটাচামচ ছুরি দেন কেন ? ঠ্যাঙটা ধরেই তো বেশ খাওয়া যায়। কাকু মুখ গোমড়া করে বলতেন…হইসে, আর উপদেশ দিতে লাগত না। তাড়াতাড়ি খাইয়া টেবিল খালি কর। বাইরে লাইন দেখছ নি ?
যেদিন বাড়ীতে প্রথম চাউচাউ ( নুডলস ) বানানো হল সেদিন সে কি উত্তেজনা ! মাও বানাচ্ছেন। খেতে বসে চামচ দিয়ে তো আর তুলতে পারিনা। পিছলে পিছলে প্লেটেই গিয়ে পড়ে । অনেক যুদ্ধের পর মা বললেন ..চ' আমরা হাত দিয়েই খাই। হাত দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস খেলাম। আমাদের বাড়ীতে তখন কাঁটাচামচ ছিল না। আমার মনে হয় মায়ের বাড়ীতে এখনও নেই ।
বিয়ের পর স্বামী আমাকে কাঁটাচামচ ছুরি ধরা শিখিয়েছে । ওদের অফিসের এক গেট টুগেদারে গিয়ে আমার হিমশিম অবস্থা দেখে কানে কানে এসে বলল..হাত দিয়ে খাও, কিচ্ছু হবে না। কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল। বাকী বৌগুলো কি সুন্দর টুকটুক করে খাচ্ছে আর পুরকীর বৌ কিনা হাত দিয়ে খাবে ? কোনমতেই না। যা খাবো চামচ কাঁটাচামচ দিয়েই খাবো। পেট না ভরলে না ভরুক। পেট ভরে নি কিন্তু যতক্ষণ ডাইনিং টেবিলে ছিলাম কাঁটাচামচটাকে আঁকড়ে ধরেই বসে ছিলাম। বাড়ী ফেরার পর স্বামী শেখালো..কোন হাতে কোনটা ধরতে হয়, কি করে তুলতে হয় । কাঁটাচামচ দিয়ে সোজা তুলতে হয় না..চামচটাকে উল্টে ধরে তুলে মুখে দিতে হয়। খাওয়া শেষে কাঁটা, ছুরি, চামচ কেমন করে রাখতে হয়। ( আমার এখনও শিখে ওঠা হয়নি যদিও। 😀)
এখন তো সব শিখে গেছি কিন্তু সব কিছু হাত দিয়ে খেতেই পছন্দ করি। নুডলস ছাড়া সব কিছু আমি হাত দিয়ে খাই। তবে এসব দিয়ে খেতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। কত জায়গায় যে কাঁটাচামচ ছিটকে পড়েছে, ছুরি দিয়ে কাটতে গিয়ে প্লেট উল্টে গেছে। রেস্তোরাঁর বেয়ারা অব্দি বলেছে.." ম্যাডাম, এগুলো সব রান্না করা জিনিস..কাঁচা নয়। অত গায়ের জোরে কাটতে যাবেন না। হালকা একটা টান মারুন। " কি আর বলবো ওকে ? বাড়ীতে লাউকুমড়ো কাটতে কাটত এরকমই অভ্যাস হয়ে গেছে। আজকাল লোকে তো দেখি বাইরে গিয়ে ডাল ভাতও চামচ দিয়ে খায়। খাক গে..আমার হাত জিন্দাবাদ ।
No comments:
Post a Comment