মস্তিষ্কের গঠন সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
আমাদের মস্তিষ্ক তিনটি অংশে বিভক্ত-
- অগ্র মস্তিস্ক / গুরু মস্তিষ্ক (Forebrain)
- মধ্য মস্তিষ্ক (Midbrain)
- পশ্চাৎ মস্তিষ্ক / লঘু মস্তিষ্ক (Hindbrain)
অগ্র মস্তিষ্ক আবার তিনটি অংশে বিভক্ত-
- সেরেব্রাম
- থ্যালামাস
- হাইপোথ্যালামাস
সেরেব্রাম এর একদম নিচে, থ্যালামাসের দুই পাশে একধরনের জটিল গঠন বিদ্যমান যার নাম লিম্বিক সিস্টেম। হাইপোথ্যালামাস, হিপ্পোক্যাম্পাস, এমিগডালা আর আশেপাশের সামান্যকিছু অংশ লিম্বিক সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত।
(ছবিসূত্রঃ The Limbic System)
এই লিম্বিক সিস্টেম যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ আমরা ভাবতেও পারছি না। ক্ষুধা, তৃপ্তি, ভয়, মানসিক প্রতিক্রিয়া, স্মৃতি এসবের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সে সামলে থাকে।
এবার একটু নিউরন নিয়েও লেখাপড়া করা যাক, অনুভূতির বাহকই তো সে।
একটি নিউরন দুটি অংশ নিয়ে গঠিত
- কোষদেহ
- প্রলম্বিত অংশঃ কোষ দেহের আশপাশ থেকে হরিণের শিং এর মতো বের হওয়া অংশগুলোর নাম ডেনড্রাইট। আর নিচ থেকে লম্বা সুতার মতো অংশটির নাম অ্যাক্সন।
ডিপ্রেশন
মন মেজাজের বিশৃঙ্খল অবস্থা যা আমাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি কিংবা আচরণকে প্রভাবিত করে, তাই ডিপ্রেশন। বেশ এলোমেলো মানসিক অবস্থা যা কারো ক্ষেত্রে খুব অল্প সময় স্থায়ী হয় আবার কারো ক্ষেত্রে কয়েক বছর স্থায়ী হতে পারে। দুই একদিন কোন ব্যাপার নয় কিন্তু বছরের পর থেকে যাওয়াটাই বিপজ্জনক।
দীর্ঘমেয়াদি ডিপ্রেশন শুধু দৈনন্দিন কাজকর্মেই প্রভাব ফেলে না, প্রভাব ফেলে শারীরিক অবস্থার উপরও। কীভাবে বুঝতে পারবো কেউ একজন দীর্ঘমেয়াদি ডিপ্রেশন এর মধ্যে আছে? নিচের লক্ষণগুলোর মধ্যে প্যাঁচ বা তার অধিক লক্ষণ দিনে অন্তত একবার দুই সপ্তাহ জুড়ে দেখা দিতে হবে-
- খুব বেশি কিংবা খুব কম ঘুম হওয়া
- অস্থিরতা
- যেই কাজগুলো একসময় খুব ভালো লাগতো সেগুলোতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
- অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া
- ক্ষুধা বেশ বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া
- আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালানো
- একাধিকবার মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার চিন্তা করা
- অনবরত আশাহীনতা কিংবা দুঃখবোধ হওয়া
- কোন কিছু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা চিন্তা করতে ঝামেলায় পড়ে যাওয়া সাথে মনোযোগের যথেষ্ট ঘাটতি
- মানসিক অবসাদ
- অযথা নিজেকে অতিরিক্ত মূল্যহীন মনে করা, অপরাধী ভাবা
(বিঃদ্রঃ রোগের লক্ষণগুলো নিজের সাথে মিলিয়ে নিজেই আবার রোগী না সেজে বসি। সমস্যা দেখা দিলে আমরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবো।)
কিন্তু মানুষ ঠিক কি কারনে দীর্ঘমেয়াদী ডিপ্রেশনে পড়ে যায় তা পুরোপুরি জানা এখনো গবেষকদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে তারা কিছু বিষয় অনুমান করতে পারে।
- কঠিন কোন ঘটনা জীবনে ঘটে যাওয়াঃ খুব কাছের কোন মানুষকে হারিয়ে ফেলা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক অশান্তি, হঠাৎ চাকরী হারিয়ে বেকার হয়ে যাওয়া- এসবের জন্য মানুষ ডিপ্রেশনে পড়ে যেতে পারে।
- হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়াঃ শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হবার কারনেও অনেকের মাঝে ডিপ্রেশন তৈরি হতে পারে। এই যেমন থাইরয়েড হরমোনের কম বেশিতে ঝামেলায় পড়ে যেতে হয়।
- জৈব রাসায়নিক বস্তুর ভূমিকাঃ মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে বেশ কিছু রাসায়নিক বস্তুর অস্বাভাবিকতার জন্যও সমস্যা ঘটতে পারে।
- জিনতাত্ত্বিক প্রভাবঃ শরীরের সমস্ত জৈব রাসায়নিক ক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন প্রয়োজন প্রোটিন। আর এই প্রোটিন তৈরির কোড আসে জিন থেকে। এমনকি আমাদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার জন্যও প্রয়োজন প্রোটিন যার উৎস কিনা জিন। এই জিনে যদি কোন ফল্ট দেখা দেয় কিংবা ফল্টওয়ালা জিন বংশানুক্রমে পেয়ে থাকি তাহলেও সমস্যা দেখা দিবে।
- অন্যান্য রোগবালাইঃ শরীরে জটিল কোন রোগের আবাস থাকলেও ডিপ্রেশনের মধ্যে চলে যেতে হয়।
হতাশা মস্তিষ্ককে কীভাবে প্রভাবিত করে?
আমাদের মস্তিষ্কের বাইরের অংশ ধূসর বর্ণের যা গ্রে মেটার নামে পরিচিত। এর বর্ণ ধূসর হবার কারন এখানে নিউরনের কোষদেহ, ডেনড্রাইট আর অ্যাক্সন টারমিনালের আধিক্য। ডিপ্রেশনে থাকা মানুষদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই গ্রে মেটারের স্তরটি আরও পুরু হয়ে যায়।[1]
হিপ্পোক্যাম্পাস স্মৃতি জমা রাখে এবং কোর্টিসল নামক হরমোন ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে চিনির ভারসাম্য রাখা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতি গঠনে সাহায্য, জৈবিক কার্যকালাপ নিয়ন্ত্রণ কিংবা শরীরে কোন স্থানের প্রদাহ কমাতে কোর্টিসল সক্রিয় ভূমিকা রাখে। এটি স্ট্রেস হরমোন নামেও পরিচিত। তো আমরা ডিপ্রেশনে গেলে এই কোর্টিসল এর ক্ষরণ বেড়ে যায়। যার ফলে দেখা গেছে মস্তিষ্কের একেবারে সামনের দিকের অংশ এবং হিপ্পোক্যাম্পাস সংকুচিত হয়ে পড়ে।[2]
রাগ, সন্তুষ্টি, ভয়, দুঃখ- এগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে এমিগডালা। ডিপ্রেশনের সময়ে এটি অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে যায় এবং এর কার্যক্রমে বেশ অস্বাভাবিকতা লক্ষণীয়।[3] তাই ডিপ্রেশন দীর্ঘস্থায়ী হলে এখানে বেশ খারাপ প্রভাব পড়ে যা আমাদের ইমোশনাল বিষয়গুলোকেও প্রভাবিত করে।
এসবের সাথে থ্যালামাস এবং হাইপোথ্যালামাসও আক্রান্ত হয়। থ্যালামাস রিলে স্টেশন হিসেবে কাজ করে, সেরেব্রামের কাছে তথ্য হস্তান্তরের প্রধান দায়িত্ব তার। অন্যদিকে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা, অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ হরমোন ক্ষরণ, বিভিন্ন অঙ্গের সমন্বয়ে হাইপোথ্যালামাস কাজ করে থাকে। ডিপ্রেশনের সময় এদেরও অস্বাভাবিকতা লক্ষণীয়।
ডিপ্রেশনের সময় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে লিম্বিক সিস্টেমের উপর যে কিনা আমাদের মানসিক অবস্থার দেখভালের দায়িত্বে। কাজ সামলানো যার দায়িত্ব যার কাঁধে সে যদি অস্বাভাবিক আচরণ করে তাইলে তো বিপদ আঁচ করতেই পারছি।
ডিপ্রেশনের জন্য মস্তিষ্কে প্রভাব পড়ে নাকি মস্তিষ্কের উল্টাপাল্টা আচরণে ডিপ্রেশনে পড়তে হয়- বেশ জটিল বিষয় যা নিয়ে গবেষকদের গবেষণা মনে হয় না এখনো শেষ হয়েছে।
কিন্তু ডিপ্রেশনের সময় মস্তিষ্কে যে ভয়াবহ পরিবর্তন আসে বুঝতে পারলাম নিশ্চয়। ফলস্বরূপ শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট হবার পাশাপাশি কাজেকর্মে কিংবা মানসিক অবস্থায় আমূল পরিবর্তন চলে আসে, জীবন হয়ে ওঠে অতিষ্ঠ।
তাই সমস্যাতে পড়লে চেপে না গিয়ে অবশ্যই সাহায্য করতে পারবে এমন কারো থেকে সাহায্য নিতে হবে।
Be Happy :)
ফুটনোটগুলি
No comments:
Post a Comment